ছবি : ঢাকা ইনসাইটস
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. এম এম শরীফুল করিমের কক্ষ যেন ছাত্রদলের অস্থায়ী একটি কার্যালয়। ক্যাম্পাসে সকল ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন সময় তাঁর কক্ষে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের মত বিনিময় ও সাক্ষাৎ করতে দেখা যায়। বিষয়টি নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এই বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে শরীফুল করিমের কক্ষে নিয়মিত নজরদারি করেন এই প্রতিবেদক। ফলে দেখা যায়, ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন, সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল বাশার ও শাফায়েত সজলসহ আহ্বায়ক কমিটির নেতাকর্মীদের এই কক্ষে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা ক্যাম্পাস রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বলেও জানা যায়।
গত ১৪ই মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ছাত্রদল। এরপরেই ছাত্রদল নেতাকর্মীদের দীর্ঘক্ষণ শরীফুল করিমের কক্ষে অবস্থান করতে দেখা যায়।
১৫ই মে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সমর্থিত শিক্ষকদের সংগঠন ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)’–এর কুবি শাখার কমিটি গঠিত হয়েছে। এতে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহিন উদ্দিন। তাঁকে শরীফুল করিমের কক্ষে ফুলেল শুভেচছা জানায় ছাত্রদল। এসময় উপস্থিত ছিলেন আহ্বায়ক আবদুল্লাহ আল মামুন, সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ, যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল বাশার, সাইদুল ইসলাম শাওন ও শাফায়েত সজল, আহ্বায়ক সদস্য মোতাসিম বিল্লাহ পাটোয়ারী রিফাত।
বিভাগের এক সিনিয়র শিক্ষক বলেন, বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা নিয়মিত আসেন। এসব নেতাদের বেশিরভাগেরই ছাত্রত্ব নেই। যেহেতু এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র নয় তাই তাঁরা বিভাগে আসলে আমরা বিব্রত হই।
শরীফুল করিম বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি কোন শিক্ষার্থী, তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, আওয়ামী সরকারের সময় স্যারের যেমন একটা খ্যাতি ছিল এটা এখন কমে যাচ্ছে। কারণ তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন এবং ছাত্রদলের একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে একজন শিক্ষক হিসেবে উনাকে আমারা যেভাবে দেখতাম এখন সেভাবে দেখিনা। উনি এখন ফুল টাইম রাজনীতি আর পার্ট টাইম শিক্ষকতা করেন। বিভাগে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিয়ে তিনি প্রায় সময়ই সাক্ষাৎ ও সভা করেন। এই নেতাকর্মীরা বিভাগে আসার কারণে শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে।
আওয়ামী সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম সিন্ডিকেট সভায় সকল ধরনের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ শরীফুল করিমের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত। বিভিন্ন সময় শরীফুল করিমকে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে নিয়ে শো-ডাউন দিতেও দেখা যায়।
এ বিষয়ে কুবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ বলেন‚ ‘আমি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমি আমার বিভাগে যাবো এটা স্বাভাবিক৷ ক্যাম্পাসে প্রথম থেকেই রাজনীতি উন্মুক্ত ছিলো না। আবার সকলেই রাজনীতি করেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই রাজনীতির বাইরে হয় না। যে আন্দোলন হয়েছিলো জুলাই আগস্টে সে আন্দোলনও রাজনীতি ছাড়া সম্ভব ছিলো না। আমরা শরিফুল করিম স্যারের রুমে মাহিন স্যারকে স্বাগত জানিয়েছি। স্যারের কাছে যখন যাওয়া হয় আমরা পরামর্শ করতে যাই, যেহেতু তিনি শিক্ষক নেতা ছিলেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করিম বলেন‚ ‘শুভ আমার ছাত্র। তার ছাত্রত্ব না থাকলেও সে তো ডিপার্টমেন্টের সাথে জড়িত। অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী হোক, আমার কাছে তো ছাত্রদল ছাড়াও অন্য দলের ছেলেরাও আসে। আমার পারসেপশনে এখানে কোন পলিটিক্যাল কার্যক্রম হচ্ছে না। কারো পারসেপশনে যদি হয় তাহলে সেটা আমার বিবেচনায় নিতে হবে।’
বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘ইউট্যাবের’ সাধারণ সম্পাদককে বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে এনে ছাত্রদলের ফুল দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন‚ ‘ মাহিন আমার পাশের ডিপার্টমেন্টের। সেজন্য সে এখানে আসছে। তখনই কো-ইন্সিডেন্টলি তাঁরাও (ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা) আসছে৷ ইউট্যাব বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একটি পেশাজীবি সংগঠন। এটি কোন রাজনৈতিক সংগঠন না। আমার কাছে অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীরাও আসে৷ তাদের সাথেও কথা বলি।
প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হাকিম বলেন‚ ‘শিক্ষকের কক্ষে তাদের নিয়মিত যাতায়াতের ব্যাপারে শুনলাম। এখন তারা যদি কোন দলের হয় তাহলে সেটা করা অবশ্যই উচিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ। একজন শিক্ষকের রুমে কোন দলীয় প্রার্থী যেতে পারে না। তাছাড়া শিক্ষকের রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ক্যাম্পাসে এসব দলাদলি চায় না। তারা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। শিক্ষকরা রাজনীতি করলে সে ব্যাপারে প্রশাসন সর্বোচ্চ কনসার্ন থাকবে। প্রক্টর হিসেবে আমি চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন রাজনীতি যেন না হয়। শিক্ষার্থীরা বিব্রত হলে যদি আমাদের কাছে লিখিত জানায় তাহলে আমরা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবো।’
এছাড়াও ড. শরীফুল করীমের বিরুদ্ধে শিক্ষককে মারধর ও হেনস্তা, নিয়োগে অনিয়ম, রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাসে রাজনীতিতে সক্রিয়তাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
মতামত