ঢাকার ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এখন আর শুধুমাত্র বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফল নয়,এটি শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ন ও প্রাকৃতিক জলাধার ধ্বংসের এক ভয়াবহ পরিণতি। ১৯৮০ সালের দিকে যেখানে ঢাকার প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা জলাভূমি ছিল, আজ তা নেমে এসেছে ২ শতাংশেরও নিচে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২০২৩ সালের এক গবেষণা বলছে, জলাধার হারিয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকা শহর বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ৬০% দ্রুত হারে উত্তপ্ত হচ্ছে। এই কারণে শহরটি একটি ভয়াবহ " হিট আইল্যান্ড"-এ রূপ নিয়েছে, যেখানে কংক্রিটের দালানগুলো দিনের তাপ শোষণ করে রাতে তা নির্গত করে, ফলে রাতের তাপমাত্রা ও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে । যার ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠছে অসহনীয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও জলাধার
জলাধারগুলো প্রাকৃতিকভাবে তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কংক্রিটের তুলনায় পানির তাপ ধারনক্ষমতা প্রায় ৪.৭৫ গুণ বেশি, যার ফলে তা দিনে তাপ শোষণ করে ধীরে ধীরে রাতে তা নির্গমণ করে, যা দিন-রাতের তাপমাত্রার পার্থক্যকে কমিয়ে দেয়।। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের এক গবেষণা বলছে, এক হেক্টর পুকুর দৈনিক ৫০–৬০ গিগাজুল তাপ শোষণ করতে পারে, যা আশেপাশের এলাকার রাতের তাপমাত্রা ২–৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারে!
এছাড়া, জলাধারের বাষ্পীভবন প্রক্রিয়াও তাপ শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন প্রতি বর্গমিটার জলাভূমি থেকে ১০–১৫ লিটার পানি বাষ্প হয়ে যায়, যা পরিবেশ থেকে সুপ্ত তাপ শোষণ করে বাতাসকে ঠান্ডা করে এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধি করে। ঢাকায় হারিয়ে যাওয়া ৩২০ হেক্টর জলাভূমি যদি রক্ষা পেতো, তবে সেগুলো প্রতিদিন প্রায় ৩২০ কোটি লিটার জলীয়বাষ্প তৈরি করতে পারতো যা পরিবেশের তাপমাত্রা ৪–৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমাতে পারতো।
জলাধার হ্রাস বনাম উষ্ণতা বৃদ্ধি
১৯৮৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, ঢাকার নগরায়ন বেড়েছে লাগামহীনভাবে, অথচ জলাধার রক্ষা কার্যত অবহেলিত থেকেছে বলা চলে। পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (ইএসডিও)-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ছিল প্রায় ২,০০০ পুকুর ও ৪,২০০ হেক্টর জলাভূমি। ২০২৩ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯টি পুকুর ও ৮০ হেক্টর জলাভূমিতে।
এর ফলে শহরের গড় তাপমাত্রা ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বেড়েছে ২.১°C, যেখানে পার্শ্ববর্তী গ্রামীণ এলাকার বৃদ্ধি মাত্র ১.৩°C—মানে শহরে তাপমাত্রা বেড়েছে ৬২% বেশি হারে। বিশেষ করে ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবছর জলাধার হারানোর হার ৮.৫% এবং তাপমাত্রা বেড়েছে বছরে ০.১২°C হারে।
বুয়েটের ২০২৩ সালের থার্মাল ইমেজিং বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কংক্রিটঘন এলাকা যেমন মিরপুর ও গুলশান, সেখানে তাপমাত্রা জলাধারসংলগ্ন অঞ্চল যেমন ধানমন্ডি লেক বা রমনা পার্কের তুলনায় ৫–৭°C বেশি। এমনকি রাতের বেলায়ও এই পার্থক্য থাকে ৪–৫°C, যা ঘুম, দেহঘড়ি, ও মানবদেহের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায়।
জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব
স্বাস্থ্য সংকট: তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি চরমে। ২০২২ সালে হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন ১১২ জন, ২০১৫ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ৩০০% বেশি। একই সময়ে আইসিডিডিআরবি জানায়, শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে ঘামাচি, পানিশূন্যতা ও শ্বাসকষ্টের হার বেড়েছে ৪০%।
জ্বালানি সংকট: ঘরের ঠাণ্ডা রাখার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ২০২২ সালে ঢাকার বিদ্যুৎচাহিদা পৌঁছেছে ৩,৮০০ মেগাওয়াটে—২০১৫ সালের তুলনায় ৬০% বেশি। ফলে বাড়তি খরচ হয়েছে ২৬,০০০ কোটি টাকা, যার বেশিরভাগই গেছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানিতে।
শ্রম ও অর্থনীতির ক্ষতি: বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৪০% খোলা জায়গায় কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিদিন ২–৩ ঘণ্টা কম কাজ করতে পারছেন গরমের কারণে, যার ফলে জাতীয় উৎপাদন কমছে ১.২% হারে। এছাড়া, তাপজনিত রোগ চিকিৎসায় বছরে খরচ হচ্ছে প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা, যা শহরের স্বাস্থ্য বাজেটের ১৫%।
জলাধার হারালে শহরের ঠাণ্ডা রাখার জন্য এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়ে, যা বাড়ায় বিদ্যুৎচাহিদা ও কার্বন নিঃসরণ। এতে করে শহরের আরও উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, ২০১০ সালের পর থেকে ঢাকার নদী ও খালগুলোর পানিপ্রবাহ কমেছে ৩০%, যার ফলে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়েছে ১৮% এবং হিট ইনডেক্স পৌঁছেছে ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায়।
উক্ত সমস্যার সমাধান হতে পারে, বিজ্ঞানসম্মত ও সমন্বিত পদক্ষেপসমূহ।
জলাধার পুনরুদ্ধার: পুকুর, খাল ও জলাভূমি শনাক্ত করে সেগুলোর সুরক্ষা ও পুনর্বাসনে জিআইএস-ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ।
সবুজ অবকাঠামো: ছাদবাগান ও শহুরে বনায়নের মাধ্যমে ছায়া ও বাষ্পীভবন বাড়ানো।
সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা: জলাভূমিতে নতুন নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা।
গণপরিবহন উন্নয়ন: ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের সংখ্যা কমিয়ে তাপ ও দূষণ কমানো।
আইন প্রয়োগ: জলাভূমি সংরক্ষণ আইন ও ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান কঠোরভাবে বাস্তবায়ন ও তদারকি করা।
ঢাকাবাসী এখন এক "হিট আইল্যান্ডে" আটকা পড়ার দ্বারপ্রান্তে—যেখানে তাপ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি একে অপরকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো শহরের হারিয়ে যাওয়া জলাধার ফিরিয়ে আনা ও টেকসই নগর নকশা গ্রহণ করা। এটি এখন বিলাসিতা নয়, বরং ২ কোটিরও বেশি মানুষের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই।
- অর্ঘ্য প্রতীক চৌধুরী
শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, বিইউপি।
মতামত