শেরপুরের নালিতাবাড়ীসহ গারো পাহাড়ঘেঁষা সীমান্তবর্তী এলাকায় মানুষ ও বন্য হাতির দ্বন্দ্ব এক করুণ ও দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি রাতে ৫০–৫৫টি বন্য হাতির পাল লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। ধানক্ষেত নষ্ট হওয়া ছাড়াও হাতির তাণ্ডব আর গর্জনে আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন এলাকার হাজারো মানুষ। জীবন-জীবিকা রক্ষায় জেগে জেগে পাহারা দিচ্ছেন কৃষক, অথচ মিলছে না স্থায়ী কোনো প্রতিকার।
গত এক দশকে বন্য হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৫ জন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন। অন্যদিকে, বিদ্যুতের ফাঁদ ও দুর্ঘটনায় অন্তত ৩০টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। হাতি মারা গেলে কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, জেল পর্যন্ত হতে দেখা গেছে। অথচ সেই কৃষকের ক্ষেত-ঘর নষ্ট হলে সরকারিভাবে কাগজে-কলমে ক্ষতিপূরণের কথা বলা হলেও অনেকেই সেই সহায়তা পান না বা তা পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়। সাংবাদিকরা এই চিত্র তুলে ধরলেও সমাধান থাকে কেবল নথিপত্রেই। প্রশ্ন উঠছে—এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়? এর স্থায়ী সমাধান কি শুধুই কাগজে-কলমে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৯৫ সালে ভারতের মেঘালয় থেকে দলছুট হয়ে আসা একটি হাতির দল গারো পাহাড়ে প্রবেশের পর থেকেই এই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একসময় শাল ও গজারি বনের প্রাচুর্য তাদের খাদ্য জুগিয়েছিল। কিন্তু বন উজাড় ও বসতি সম্প্রসারণের ফলে সংকুচিত হয়ে পড়েছে তাদের প্রাকৃতিক আবাস। খাদ্যের অভাবে তারা লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে—ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গারো পাহাড়ে প্রায় ৬০-৭০টি হাতি বসবাস করছে। ক্ষুধার্ত হাতির দল প্রায়শই ফসল ও বাড়িঘরে আক্রমণ করছে। ক্ষতিগ্রস্তরা অভিযোগ করেছেন, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, “গারো পাহাড়ের ঝিনাইগাতী, শ্রীবর্দী ও হালুয়াঘাট উপজেলায় ২০১৬ সালে ১৩ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী নির্মাণ করা হয়েছে। গোপালপুর ও হালুয়াঘাটে আরও ২ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে আরও ৮ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী নির্মাণের কাজ চলছে। পাশাপাশি নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৫০ কিলোমিটার সৌর বেষ্টনী ও বায়োফেন্স নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”
মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. দেওয়ান আলী বলেন, “ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না দিলে হাতির অনুপ্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।”
নালিতাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোহেল রানা বলেন, “এই এলাকায় হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। ক্ষতিগ্রস্তরা থানায় এসে হাতির বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি করার পর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তারা ক্ষতিপূরণ পান। তবে স্থায়ী সমাধান এখনও অধরা।”
স্থানীয় আদিবাসী নেতা লুইস নেংমিনজা বলেন, “বনে খাবারের অভাব হওয়ায় হাতিরা লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এর ফলে মানুষকে চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতির প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা এবং তাদের চলাচলের পথে মানুষের বসতি হ্রাস করে মসলা জাতীয় ফসলের চাষ চালু করলে সংঘাত অনেকটাই কমানো সম্ভব। কিন্তু এইসব সুপারিশ বাস্তবায়নে যে গাফিলতি বা ধীরগতি রয়েছে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ—হাতির মৃত্যু হলে মামলা হয় কৃষকের বিরুদ্ধে, অথচ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা যায় সরকারি ফাইলে; দুঃখ থাকলেও বিচার নেই। সাংবাদিকরা বছরের পর বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছেন—সংঘাতের সংখ্যা বাড়ে, ব্যথা বাড়ে, পরিবর্তন হয় না। তাই আবারও প্রশ্ন—গারো পাহাড়ে মানুষ ও হাতির এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধান কি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এবার বাস্তব কোনো পদক্ষেপ দেখা যাবে?
মতামত