ছবি : ঢাকা ইনসাইটস
কিশোরগঞ্জ-ঢাকা রুটে চলাচলকারী কিশোরগঞ্জ জেলা সদর, পাকুন্দিয়া, গাজীপুরের কাপাসিয়া,কটিয়াদি, হেসেনপুর, নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলাসহ আশপাশের লাখ লাখ মানুষ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তোয়াক্কা না করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় যাত্রীবাহী পরিবহনগুলো ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে। সবগুলো পরিবহন কোম্পানি যাত্রীদের কাছ থেকে গেটলক সার্ভিসের ভাড়া আদায় করলেও বাসগুলোতে সেবা মিলে লোকাল সার্ভিসের। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলে যাত্রীদেরকে অনেক সময় মারধরের শিকার হতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় ‘ঢাকা পরিবহন’, ‘প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন’ ও ‘ভাওয়াল পরিবহনে’র প্রায় শতাধিক বাস কাপাসিয়া সদর থেকে ঢাকা গেলেও বর্তমানে কাপাসিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজধানী কিংবা গাজীপুর সদরের উদ্দেশ্যে কোনো বাসই যাত্রা শুরু করে না। ফলে যাত্রার শুরুতে সিট মিলে না এখানকার অধিকাংশ যাত্রীর। এমনকি লোকাল সার্ভিসের মতো সেবাদাতা ২টি পরিবহনের বাস ছাড়া অন্যান্য বাসগুলোকে কাপাসিয়া সদরে এবং আশপাশের অধিকাংশ স্টপেজে যাত্রী উঠানামা করতে দেওয়া হয় না। ফলে ওই নির্দিষ্ট পরিবহনের বাসে যাত্রীরা তাদের ব্যাগ ও ছোট খাট জিনিস নিয়ে উঠতে গিয়ে মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন।
পরিবহন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে কাপাসিয়া হয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় জলসিড়ি এক্সপ্রেসের ৬৪টি, অনন্যা পরিবহনের ৪৭টি, উজানভাটি পরিবহনের ২৬টি এবং অনন্যা ক্লাসিকের ৫৪টি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে। পাশাপাশি মহাখালী বাসটার্মিনালের উত্তর পাশের একটি পেট্রোল পাম্প এলাকা থেকে কাপাসিয়া হয়ে নরসিংদী জেলার মনোহরদীর চালাকচর পর্যন্ত ‘সম্রাট পরিবহনে’র ৪৫টি এবং সম্রাট ট্রান্সলাইনের ১৯টি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করে। তাছাড়া গাজীপুর সদর থেকে কাপাসিয়ার সর্ব উত্তরের জনবহুল স্থান টোক বাজার পর্যন্ত ‘পথের সাথী রাজদূত’ পরিবহনের প্রায় ৪০টির মতো যাত্রবাহী বাস চলাচল করে থাকে।
কাপাসিয়া সদরের ফজলুর রহমান নামের এক যাত্রী জানান, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে কাপাসিয়ার দূরত্ব মাত্র ২৯ কিলোমিটার। সেখান থেকে ‘অনন্যা পরিবহন’, ‘অনন্যা ক্লাসিক’ ও ‘জলসিড়ি এক্সপ্রেসের’ বাসে কাপাসিয়া আসতে যাত্রীদেরকে ২০০ টাকা দিয়ে একটি টিকিট কিনতে হয়। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে কাউন্টার থেকে বলা হয়, যেহেতু কাপাসিয়ায় তাদের স্টপেজ নেই; তাই টোক বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত টিকিট কিনে কাপাসিয়া যেতে হবে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করলে নানা কটু কথা শুনতে হয় এবং হেনস্তার শিকার হতে হয়।
উপজেলার টোক ইউনিয়নের বীর উজুলী এলাকার মামুন মিয়া জানান, বীর উজুলি থেকে গাজীপুর চৌরাস্তার দূরত্ব ৪৪ কিলোমিটার এবং অনন্যা ক্লাসিক পরিবহনের টিকিটের গায়ে ১৫০ টাকা লেখা থাকলেও এখানে ভাড়া আদায় করা হয় ১৯০ টাকা।
টোক এলাকার এই সড়কে চলাচলকারী একজন জানান, টোক থেকে কাপাসিয়ার দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার হলেও পথের ‘সাথী রাজদূত’ পরিবহনে ভাড়া আদায় করা হয়। অন্যান্য পরিবহনগুলোতে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে টোক পর্যন্ত ভাড়া গুণতে হয় ১৭০ টাকা থেকে ২শ’ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা-কাপাসিয়া-মনোহরদী-চালাকচর সড়কে ‘সম্রাট পরিবহন’ ও ‘সম্রাট ট্রান্সলাইন’ একমাত্র যাত্রীবাহী পরিবহন হওয়ায় যাত্রীরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কাপাসিয়া থেকে সালদৈ চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে তাদেরকে ভাড়া দিতে হয় ৫০ টাকা।
কিশোরগঞ্জ সদরের নিয়মিত বাসে যাতায়াতকারী আফিফ ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানি তে চাকুরি করেন তিনি জানান, ঢাকা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব ১০২ কিলোমিটার হলেও অনন্যা পরিবহনে তাদেরকে ভাড়া দিতে হয় ৩৩০ টাকা। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ সড়কে ভাড়া নৈরাজ্যের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত বলে তিনি জানান।
জ্বালানি তেলের দাম উঠানামার পর সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসে প্রতিকিলোমিটার ২ টাকা ১২ পয়সা ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। ভাড়ার এই নতুন হার ডিজেলচালিত বাসের জন্য প্রযোজ্য হবে এবং সিএনজিচালিত বাসে ভাড়া এক পয়সাও বাড়ানো যাবে না বলে সতর্ক করা হয়। কিন্তু ঢাকা-কাপাসিয়া-কিশোরগঞ্জ রুটে চলাচলরত চারটি কোম্পানির বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া লেখা থাকে। তদুপরি টিকিটের গায়ে আবারো নতুন করে সিল মেরে গড়ে সাড়ে তিন টাকা থেকে পাঁচ টাকা কিলোমিটার হারে ভাড়া আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কোম্পানিগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে নিজেদের মতো করে একটি ভাড়ার তালিকা করে রেখে দেন। সাধারণ যাত্রীরা তালিকা দেখতে চাইলে তা দেখিয়ে অনেকটা জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। বেশির ভাগ বাস আগে থেকেই তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি ভাড়া আদায় করলেও তেলের দাম কমার পর সরকার ভাড়া কমালে তা আমলে নেয়নি। পরিবহন কোম্পানির মালিকরা সংঘবদ্ধ ও প্রভাবশালী হওয়ায় এ পথের যাত্রীরা ভাড়া নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল পান না বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন নেতা দাবি করেন, এ সড়কে অতিরিক্ত বাসের কারণে ভয়াবহ যানজট হয়। এ কারণে বর্তমানে তাদের বাসগুলো পর্যাপ্ত যাত্রী পাচ্ছেন না এবং যাতায়াতে সময় বেশি লাগায় ট্রিপ কমে গেছে।
মতামত