ছবি : প্রতিনিধি
নজরুলের বিখ্যাত ‘কুলি-মজুর’ কবিতা সাম্যবাদি চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়ে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণের অনুপ্রেরণা যোগায়। নজরুল শ্রমিকদেরকেও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি একটি শ্রমিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখান এ কবিতায়। আজ পহেলা মে; আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। বিশ্বের অনেক দেশেই এ দিনটিকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে শ্রমিকদের অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় ৮০ টি দেশে এ দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে বিবেচনা করে সরকারি সকল অফিস বন্ধ রাখা হয়।
এ দিনটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য হলো‚ ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হে মার্কেটের’ সেই আন্দোলন‚ যা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়েছিলো। এ আন্দোলনে সেদিন ৮ ঘন্টার শ্রমদিন এর দাবিতে রাস্তায় নামা শ্রমিকদের উপর গুলি করা হয়েছিলো। ফলে ঝরে যায় ১১ জন শ্রমিকের তরতাজা প্রাণ।
শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা শ্রমদিন করার লক্ষ্যে ১৯০৪ সালে আমস্টারডামে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে \\'বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার\\' সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
উপমহাদেশে ১৯৩৮ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রদেশে শ্রমিকদের সংগঠন গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সাংগঠনিক অবকাঠামো তৈরি হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমিকদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যার ধারা ১৪ ও ২০ সরাসরি শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা তুলে ধরে। বাংলাদেশ শ্রম আইন‚ ২০০৬ অনুযায়ী দৈনিক সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারন করা হয়েছে।
কুমিল্লার একটি ইটভাটার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা দৈনিক ৮-৯ ঘন্টা পরিশ্রম করে। উৎপাদনের ভিত্তিতে তাদের সাপ্তাহান্তে বেতন দেয়া হয়। প্রতি ১০০ টি ইট তৈরির পারিশ্রমিক দেয়া হয় ৯ টাকা করে। তাদের নেই কোন শ্রমিক ইউনিয়ন, উন্নয়ন ফান্ড কিংবা কালেক্টিভ বার্গেইনিং এজেন্ট। তারা বছরের ৬ মাসই বেকার থাকে। তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ আবাসস্থান থেকে বঞ্চিত। ইটের ভাটায়ই তাদের অস্থায়ী বসতি। তাদের সাথে তাদের ছোট ছেলে-মেয়েরাও কাজ করে।
এ বিষয়ে ইনকিলাব মঞ্চ‚ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এর যুগ্ম আহবায়ক ফারুক আল নাহিয়ান বলেন‚ ‘বুর্জোয়াশ্রেণী, মালিকশ্রেণীর ক্ষমতার শীর্ষচূড়ায় থাকা এই যুগে নিষ্পেষিত, নিপীড়িত শ্রমিকদের জানাই শ্রমিক দিবসের শুভেচ্ছা। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪ তম অনুচ্ছেদে আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে—কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ আদৌ কি আমরা সংবিধানের এই ধারা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? ঈদের পূর্বে যখন সবাই হাসিমুখে বাড়ি ফেরার কথা তখন শ্রমিকেরা রৌদে পুড়ে আন্দোলন করে তার পাওনা টাকা আদায়ের জন্য। রানা প্লাজার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ কতটুকু নিরাপদ। ৮ কর্মঘন্টা শুধু কাগজে কলমেই আছে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। গর্ভকালীন সময়ে নারী গার্মেন্টসকর্মীদের বেতনটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয় না। দেশের আইন আছে, সংস্কার কমিশন ও আছে তবে এই আইন ততোদিন বাস্তবায়ন হবে না যতদিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বন্ধু হিসেবে শিল্পপতি, মালিকপক্ষের পাশাপাশি শ্রমিকরাও বিবেচ্য হবে।’
মতামত