আমার শৈশবে যে স্কুলে পড়েছিলাম সেখানে একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। ‘এ’ সেকশনে খুব ভালো শিক্ষার্থীদের রাখা হতো। ‘বি’ সেকশন বরাদ্দ ছিল মাঝারি মানের শিক্ষার্থীদের জন্য আর ‘সি’ সেকশন এ সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা করে রাখা হতো।
আমার মনে আছে একজন ইংরেজি শিক্ষকের কাছে আমাদের শ্রেণির অনেকেই প্রাইভেট পড়তাম। একদিন স্যার আমার সামনেই ‘সি’ সেকশনের একজন শিক্ষার্থীকে বললেন, “তুমি পারছো না দেখো ও ‘এ’ সেকশনের ও পারে।” আরও মনে পড়ে কোনো ট্যুরে গেলে সেকশন অনুযায়ী দল তৈরি হতো।
এ বিষয়ে শিক্ষকরা আলাদা করে আলোচনা করেননি, বরং শ্রেণির শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। কেউ কম নম্বর পেলে তাকে চরমভাবে অপমানিত হতে হতো। যাই হোক ভালো সংবাদ এই যে, আমি খবর নিয়ে জানলাম এভাবে মেধার মান অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আর নানা সেকশনে ভাগ করা হয় না সেই স্কুলে। এটা ভালো কিন্তু অনেকের জীবনে ইতিমধ্যেই অনেক রকমের অপমানের বোঝা যুক্ত হয়ে গেছে! এর মধ্যে কেউ হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছে আর কেউ পারেনি।
যত রকমের বুলিং
বুলিং যখন কেউ করে তখন সেটা সেই ব্যক্তিকে ভীষণভাবে আহত করে। যা কিনা তাকে এমনভাবে গুটিয়ে ফেলে যেমন করে শামুক তার কাঠামোর মধ্যে ঢুকে যায়! আর অপদস্থ হওয়ার পর নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে সাহস নিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন, সময়ও লাগে! এই বুলিং নানাভাবে হতে পারে মৌখিক, শারীরিক, আবেগীয়, মানসিক, সাইবার, যৌন হয়রানিমূলকসহ ইত্যাদি।
বুলিংয়ের শিকার হলে কী করবেন?
আমার শৈশবে যে স্কুলে পড়েছিলাম সেখানে একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হতো। ‘এ’ সেকশনে খুব ভালো শিক্ষার্থীদের রাখা হতো। ‘বি’ সেকশন বরাদ্দ ছিল মাঝারি মানের শিক্ষার্থীদের জন্য আর ‘সি’ সেকশন এ সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা করে রাখা হতো।
আমার মনে আছে একজন ইংরেজি শিক্ষকের কাছে আমাদের শ্রেণির অনেকেই প্রাইভেট পড়তাম। একদিন স্যার আমার সামনেই ‘সি’ সেকশনের একজন শিক্ষার্থীকে বললেন, “তুমি পারছো না দেখো ও ‘এ’ সেকশনের ও পারে।” আরও মনে পড়ে কোনো ট্যুরে গেলে সেকশন অনুযায়ী দল তৈরি হতো।
এ বিষয়ে শিক্ষকরা আলাদা করে আলোচনা করেননি, বরং শ্রেণির শীর্ষ স্থানীয় শিক্ষার্থীদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। কেউ কম নম্বর পেলে তাকে চরমভাবে অপমানিত হতে হতো। যাই হোক ভালো সংবাদ এই যে, আমি খবর নিয়ে জানলাম এভাবে মেধার মান অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের আর নানা সেকশনে ভাগ করা হয় না সেই স্কুলে। এটা ভালো কিন্তু অনেকের জীবনে ইতিমধ্যেই অনেক রকমের অপমানের বোঝা যুক্ত হয়ে গেছে! এর মধ্যে কেউ হয়তো কাটিয়ে উঠতে পেরেছে আর কেউ পারেনি।
যত রকমের বুলিং
বুলিং যখন কেউ করে তখন সেটা সেই ব্যক্তিকে ভীষণভাবে আহত করে। যা কিনা তাকে এমনভাবে গুটিয়ে ফেলে যেমন করে শামুক তার কাঠামোর মধ্যে ঢুকে যায়! আর অপদস্থ হওয়ার পর নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে সাহস নিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন, সময়ও লাগে! এই বুলিং নানাভাবে হতে পারে মৌখিক, শারীরিক, আবেগীয়, মানসিক, সাইবার, যৌন হয়রানিমূলকসহ ইত্যাদি।
গল্প ১ মৌখিক বুলিং
রনি (ছদ্মনাম) যাচ্ছিল স্কুলের করিডোর দিয়ে সে সময় পেছন থেকে কামাল ডাকল, এই বাটুল! কেমন আছিস? প্রথম প্রথম রনি কিছু মনে করতো না কিন্তু ইদানীং গায়ে লাগে। মাকে বললে বলেন, একদিন তুইও ওর মতো বড় হয়ে যাবি দেখিস! বড় বোনকে বললে বলে, ঠিকই তো বলেছে, তুই তো বাটুল! কেউ রনির মনের অবস্থা ধরতে পারছে না। ইদানীং সে ইন্টারনেট এ সার্চ দিয়ে দেখছে কীভাবে তাড়াতাড়ি লম্বা হওয়া যায়!
মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। ইতিবাচক মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করতে হবে। বন্ধু সার্কেল খুব চিন্তা ভাবনা করে তৈরি করতে হবে।
গল্প ২ শারীরিক বুলিং
পাশের বাসার কণাদের বাড়ি থেকে প্রায়ই চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। কণা (ছদ্মনাম)-এর মা বেশ রাগী মানুষ। তার সাথে কথা বলে বোঝা গেল শাসন বলতে তিনি কেবল শারীরিক শাসন বোঝেন! কণার গায়ে নানা রকমের আঘাতের চিত্র এর আগে বহুবার দেখা গেছে। ওদের বাড়ির কাজের মেয়েটিও প্রায়ই নানা কারণে মার খায়!
গল্প ৩ মানসিক ও আবেগীয় বুলিং
তনু (ছদ্মনাম)-এর বয়স এখন ২১। এখনো পড়ছে সে কিন্তু বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের এখন থেকেই বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেছে। তনু তার মাকে প্রায়ই বলতে শোনে, মেয়ের গায়ের রং তো ময়লা! গায়ের রং নিয়ে তনু শৈশব থেকেই নানা মন্তব্য শুনে বড় হয়েছে। এমনকি কেউ তাকে পোশাক উপহার দিতে গেলেও নানাভাবে রং নিয়ে মন্তব্য করেছে! সব কিছু মিলিয়ে তনু মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত।
গল্প ৪ সাইবার বুলিং
সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকাল নানা রকমের ঘটনা ঘটে। তাই সাবধান থাকতে হয়। চিত্রা (ছদ্মনাম) সাবধানতা মেনে চলার চেষ্টা করে তবুও কয়েক মাস আগে তাকে একটা একাউন্ট সম্পর্কে রিপোর্ট করতে হয়েছে। কেউ একজন তার ছবি ব্যবহার করে অন্য নামে একাউন্ট খুলেছে!
কদিন আগে তার চাচা বলছিলেন যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক বন্ধুর কাছে তার চাচার একাউন্ট থেকে ম্যাসেঞ্জারে টাকা চেয়েছে! অথচ তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না! পরবর্তীতে তিনি সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিউজ ফিডে পোস্ট দিয়েছেন এবং যেকোনো জায়গা থেকে লগ ইন ও লগ আউট করার ক্ষেত্রে সাবধানী হয়েছেন।
গল্প ৫ যৌন হয়রানিমূলক বুলিং
রূপা (ছদ্মনাম) একজন অভিনেত্রী। প্রফেশনাল কারণেই তাকে নানা মেকআপ ও গেটাপে থাকতে হয়। সে নানা জায়গায় যায়। কত মানুষ ছবি তুলে তার অজান্তেই এবং সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড হয়। ছবির সব যে খুব প্রস্তুতি নিয়ে তোলা হয় এমন নয় কাজেই তার বসার ভঙ্গি থেকে শুরু করে নানা রকমের কমেন্ট তাকে শুনতে হয়! সব যে সে জানতে পারে এমন নয়! মাঝে মাঝে তার কিছুটা মন খারাপ হয় অথচ সে যে কাজে ভালো সেগুলো দিয়েই সে চমৎকারভাবে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছে!
কেউ বুলিং করলো তারপর?
বুলিং এর চর্চা আমাদের সমাজে আছে। কেউ করলে সেখানে নানাভাবেই ভূমিকা রাখা যায়।
প্রথম, বন্ধুরা ঠাট্টা তামাশা করলে রেগে না গিয়ে সুন্দর ভাষায় বুঝিয়ে বলা যে এমন মন্তব্য ভালো লাগেনি।
দ্বিতীয়, ছোটকু, বাটকু, হ্যাংলা, কালা, ধলা, মোটু; এ ধরনের শব্দ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। হাসি ঠাট্টার ছলেও কাউকে এমন শব্দ ব্যবহার করে মন্তব্য করা ঠিক না। এছাড়া গেঁয়ো, মফস্বলের হলে মোফু এভাবেও মন্তব্য করেন অনেকে। এগুলোও সমাজে নানা রকমের বিবেধ সৃষ্টি করে! এক জায়গার মানুষের সাথে আরেক জায়গার মানুষদের সহজভাবে মিশতে বাঁধা সৃষ্টি করে।
তৃতীয়, আমরা মানুষের পরিচিতি দেওয়ার আগে অনেক সময় বলে ফেলি; লম্বু বা কালো বলেই হয়তো অনেকে বন্ধুত্ব করে না এমন ঘটনাও সমাজে ঘটেছে। অনেকেই অতিরিক্ত ওজনের কারণে বিবাহিত জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকেন।
অনেকের মাথায় টাক বলেই বিয়ে হয় না। এমন সব ক্ষেত্রে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে কেউ মন্তব্য করুক বা না করুক নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতেই হবে। নিজেকে সুন্দর করে পরিপাটিভাবে সাজিয়ে রাখা একটা ইতিবাচক বিষয়। শারীরিক নানা বিষয়ে কেউ নেতিবাচক মন্তব্যের মুখোমুখি হলেও নিজের ভেতরের মানুষটাকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না।
এমনকি শারীরিকভাবে ছোট বলেই কম্প্রোমাইজ করার বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। মূল বিষয়টি হলো নিজের কী নেই বা কম সেগুলো বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বরং ভালো গুণগুলো যা আছে সেগুলো আরও ভালোভাবে নার্চার করে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেয়াই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত।
চতুর্থ, মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। ইতিবাচক মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করতে হবে। বন্ধু সার্কেল খুব চিন্তা ভাবনা করে তৈরি করতে হবে। মানসিকভাবে আঘাত পেলেও নিজেই নিজেকে বা পরিবারের সাহায্য নিয়ে বা একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে কাউন্সিলিং করতে হবে বা সেবা নিতে হবে। যে মানুষগুলো মেরুদণ্ড সোজা করে বেঁচে থাকার পথে বাধা তাদের এড়িয়ে যেতে হবে বা তাদের সাথে অন্যভাবে মানিয়ে চলার কৌশল বের করতে হবে।
পঞ্চম, সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাউন্ট খোলা, পোস্ট দেওয়া, কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় পাসওয়ার্ড শেয়ার করা, জন্ম তারিখ শেয়ার করার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ষষ্ঠ, সাইবার বুলিং-এর ক্ষেত্রে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। মিথ্যা প্রচারণা, হুমকি, যৌন হয়রানি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ব্লক করে দেওয়ার সুবিধা নিতে হবে।
বুলিং ছোট্ট পরিসর থেকে শুরু হলেও অনেক সময় বড় আকার ধারণ করে! অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কে কখন বুলিং-এর শিকার হবে এটা বলা যায় না! কাজেই মানসিক ধৈর্যশক্তির ওপর প্রতিটি মানুষকে জোর দিতে হবে।
মানসিক বল ঠিক থাকলে পরিস্থিতিতে পড়লে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হয়! আইনের সাহায্যও প্রয়োজনে নিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মনের ভেতরে না রেখে সংকট নিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে। মানুষের জন্য পৃথিবীতে টিকে থাকা খুব সহজ নয়! কাজেই যে কোন পরিস্থিতি ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে!’
ফারহানা মান্নান,
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক
মতামত