কথায় আছে, কিছু রাতের সকাল হয় অনেক দেরিতে। আমার জীবনের সে রাত ১৮ আগস্ট, ২০১৫।
এ রাতকে আমি ভুলে যেতে চাইলেও কোনোভাবেই ভুলতে পারি না, পারব না। ফ্যাসিজমের কালো হাত অন্যায়ভাবে আমাকে ধরে নিয়ে ১০ মাস ৮ দিন বিনা অপরাধে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রেখেছিল। সন্ধ্যা-রাতের ভোট ডাকাত, নির্লজ্জ ও বেহায়া ফ্যাসিবাদী সরকার নিয়ন্ত্রিত পোষ্য চাকরদের বদৌলতে আমার নামের সঙ্গে আরও একটি নাম যোগ হয়েছিল। এক রাতেই আমি হয়ে গেলাম ‘ব্যারিস্টার সাকিলা’ থেকে ‘জঙ্গি সাকিলা’।
তাদের ভাষায় আমার অপরাধ ছিল, আমি জঙ্গিদের অর্থায়ন করেছি। আমার অপরাধ ছিল, স্বৈরাচারিণীর গোয়েবলসদের করা গায়েবি এবং মিথ্যা মামলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাই কোর্ট বিভাগ থেকে জামিন করানো এবং ২০১৩ সালের মে মাসে শাপলা চত্বরের নির্মমতার ঘটনায় হেফাজতের অসহায় আলেমদের মামলায় তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমার সৎ উদ্দেশ্য ফ্যাসিস্টদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছিল।
২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট গ্রেপ্তারের পর আমার জীবনে ধস নেমে এলো।
দীর্ঘ ১০ বছর মিথ্যা অপবাদ বয়ে বেড়াচ্ছি। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডের নামে অবর্ণনীয় নির্যাতন, কারাগারের ভিতরের অদৃশ্য নির্যাতন, সব মিলিয়ে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনের কোনো অর্থই নেই- এমন মনে হয়েছিল একপর্যায়ে। আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। ফ্যাসিস্টরা যখন দেশ দখল করে, তখন প্রথমেই তারা নিষিদ্ধ করে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার।বৈধ সবকিছু অবৈধ, আর অবৈধ সবকিছু বৈধ হয় ফ্যাসিস্টের কুশাসনে, যদিও তারাই ছিল অবৈধ। ওই পর্বে কোনো নাগরিক অধিকার থাকে না জনগণের, থাকে না কোনো স্বাধীনতা। শুধু অবৈধ একদল স্বেচ্ছাচারী এবং তাদের চেলাচামুন্ডারা স্বাধীনতা ভোগ করতে থাকে। জনগণের স্বাধীনতা খর্বকারী ফ্যাসিস্টরা যে কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে পীড়ন করছিল। আমিও এ ফ্যাসিজমের অশ্লীল পীড়নের শিকার হয়েছিলাম। রাষ্ট্র যখন অন্ধ বধির হয়ে ওঠে, তখন অন্ধ বধির বুলডোজারের নিচে নিষ্পিষ্ট হওয়াই নাগরিকের নিয়তি। আমিও হয়েছিলাম তাই।
নিজের পেশা হারিয়ে চরম নির্যাতন-নিপীড়ন ভোগ করে শেষ পর্যন্ত দেশে থাকতে না পেরে বিদেশে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলাম। জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সমাজ সবচেয়ে বেশি শক্তি ও অধিকার অর্পণ করেছে বিচার বিভাগের ওপর। তা পুরো শক্তি, সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে পালন করা বিচার বিভাগের নৈতিক কর্তব্য। যে সমাজের বিচার বিভাগ এ দায়িত্ব পালন করে না বা করতে পারে না, সে সমাজের মানুষ বড়ই অসহায়, তার বিচার বিভাগ নীতিভ্রষ্ট। ফ্যাসিস্ট শাসনামলে বিচার বিভাগও তা-ই ছিল। যার নিকৃষ্ট শিকার আমিও। দেশের আইন-শাসন-বিচার- এ ত্রয়ীর সঙ্গিন মুহূর্তে আমরা বড়ই অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম।
বিচার বিভাগ আমার মামলার কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছিল আমি রাষ্ট্রীয় ফাঁদের শিকার। তারপরও তারা আমাকে অন্যায়ভাবে দিনের পর দিন জামিন দিচ্ছিল না। সেদিনের আদালত সবার সামনে নির্দ্বিধায় বলেছেন, তাঁকে হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে দেওয়া হয়েছে, আইনের কোনো ধারার প্রয়োগ করতে তিনি অপারগ। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ভালোবেসে এ দলের কর্মীদের আইনি সহায়তা করা এবং নিপীড়িত-নির্যাতিত আলেম সমাজের পাশে দাঁড়ানো যদি জঙ্গিবাদ হয় তাহলে আমি তা-ই। ‘গণতন্ত্র’ হত্যাকারীরা নিজেদের স্বৈরাচার শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে, সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় ৭৮ বছর বয়স্ক দেশমাতাকে কী নির্মমভাবে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল তা বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব অবগত। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলা, জুলুম- এসবই ছিল ফ্যাসিবাদীদের হাতিয়ার। আমার আদর্শ, আমার শ্রদ্ধেয় বাবা মানসিক এবং শারীরিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত গ্লানি নিয়েই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। আমার বাবা দেখে যেতে পারেননি তার মেয়েকে নির্দোষ ঘোষণা করেছে ২০২৪-এর আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে অর্জিত স্বাধীন বিচার বিভাগ। এ রাষ্ট্র ১৭ বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাকে কেমোথেরাপি দিতে হবে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের ছোবলমুক্ত বাংলাদেশে এখন অনেক সংস্কারের প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে ৩১ দফার সুপারিশ করেছে। ইনশা আল্লাহ, আমার বিশ্বাস, ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে এ আন্দোলনের ফল বৃথা যাবে না। নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশিরা। আমরা ভোটাধিকার ফিরে পাব। ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করব। সে সরকার আমাদের একটা সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেবে। যে রাষ্ট্র আইনের শাসন নিশ্চিত করবে, মৌলিক অধিকার ভোগে বাধা প্রদান করবে না।
লেখক : আইনজীবী এবং বিএনপি নেত্রী
মতামত